ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সরকারি অ্যাম্বুলেন্স সেবা পাওয়া রোগী এবং তার আত্মীয়ের কাছে অনেকটা আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতোই। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা বেশির ভাগ রোগীর আত্মীয়স্বজনকে পড়তে হচ্ছে হাসপাতালের সামনে থাকা বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অ্যাম্বুলেন্সের দালালদের খপ্পরে। জরুরি প্রয়োজনে রোগীকে আনা-নেওয়া করতে চড়া ভাড়া দিতে হচ্ছে তাদের।
এ হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স আছে চারটি। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসার প্রয়োজনে ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন হাসপাতালে আনা-নেওয়া বাবদ সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে সর্বনিম্ন ভাড়া ৩০০ টাকা। জরুরি বিভাগের সামনে সাইনবোর্ডে বড় করে সরকারি অ্যাম্বুলেন্স সেবার কথা লেখা আছে। গতকাল শনিবার দেখা গেল, হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের যানবাহন শাখার সামনে দুটি ঝকঝকে নতুন এবং একটি পুরোনো অ্যাম্বুলেন্স রাখা। কিন্তু এর সেবা পেতে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে রোগীর সঙ্গে আসা আত্মীয়দের। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নিতে আসা লোকদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নিরুপায় এসব লোককে চড়া ভাড়ায় বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে দালালেরা।
গতকাল শনিবার বিকেল চারটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত একটি সরকারি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করার চেষ্টা করছিলেন দীন ইসলাম। তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে যাবেন ধানমন্ডির একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। চিকিৎসক ওই নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিকে রোগীর দাঁতের (ওপিজি) পরীক্ষা করাতে বলেছেন। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে অবশেষে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে দীন ইসলাম বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সে করে স্ত্রীকে নিয়ে রওনা দিলেন।
দীন ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেলা দুইটা থেকে অ্যাম্বুলেন্স খুঁজতাছি। বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ধানমন্ডি যেতে ভাড়া চায় ২ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। সেখানে অপেক্ষা করতে হবে শুনে আবার ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। বিকেলে একজনের কাছে সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের কথা জানতে পারি। তারপর সন্ধ্যা পর্যন্ত চেষ্টা করেও পেলাম না। কিন্তু টাকা বেশি লাগলেও রোগী তো বাঁচাতে হবে। তাই কী আর করা।’
দীন ইসলামের বাড়ি নেত্রকোনার ঠাকুরাকোনা গ্রামে। ধানের ব্যবসা করেন। গত ৩১ ডিসেম্বর তাঁর স্ত্রী আশা মণি (২১) এবং আশা মণির ভাই অটোরিকশা করে এক আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছিলেন। মোটরসাইকেল ও অটোরিকশার সংঘর্ষে আশা মণি গুরুতর আহত হন। বেশ কয়েকটি দাঁত ভেঙে গেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে পেটে প্রায় ৭০টি সেলাই দিতে হয়েছে। গলা ও ঘাড়ের বিভিন্ন জায়গায় গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে।
বিকেল চারটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত প্রতিবেদক দীন ইসলামের সঙ্গেই ছিলেন। দীন ইসলাম সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের কথা যেখানেই জানতে চাচ্ছেন, সেখানেই হাসপাতালের বিভিন্ন কর্মচারী আগ বাড়িয়ে বলতে থাকেন, ‘সরকারি অ্যাম্বুলেন্স পাইবেন না। প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা কইরা দেই।’ এসব বলে তাঁরা নিজ উদ্যোগেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অ্যাম্বুলেন্সের চালককে ডেকে আনছিলেন।
বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়ে দীন ইসলাম অবশেষে যানবাহন শাখায় অ্যাম্বুলেন্সের খোঁজ নিতে যান। সেখানে এক অ্যাম্বুলেন্সের চালক মো. জলিল জানালেন, চারটি অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে দুটিই নষ্ট। একটিতে এক রোগীকে নিতে হবে। অপর একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গেছে।’
দীন ইসলাম অনেক অনুরোধ করার পর জলিল অপর অ্যাম্বুলেন্সচালক মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে জানালেন, সেই অ্যাম্বুলেন্সটি শ্যামলীতে আছে। সেটি ফিরে এলে চালক মোহাম্মদ আলী দীন ইসলামের স্ত্রীকে নিয়ে যাবেন। কিছুক্ষণ পর জলিল একটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে চলে গেলেন। এরপর মোহাম্মদ আলী মুঠোফোনে দীন ইসলামকে জানিয়ে দিলেন, তিনি ঢাকা মেডিকেলে কখন পৌঁছাবেন ঠিক নেই। অগত্যা দীন ইসলামকে সেই বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের দালালদের খপ্পরেই পড়তে হলো।
পরে হাসপাতালের সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের সুপারভাইজার নাসির উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা শহরের মধ্যে বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীদের আনা-নেওয়ার জন্য সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে সর্বনিম্ন ভাড়া ৩০০ টাকা।
নাসির উদ্দিনও স্বীকার করলেন, হাসপাতালের সামনে অপেক্ষমাণ বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সের চালকদের সঙ্গে হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়দের একধরনের যোগাযোগ থাকে। তারা রোগীদের প্রায় সময়ই সরকারি অ্যাম্বুলেন্স নিতে নিরুৎসাহিত করে। হাসপাতালে সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা বাড়ানোর পক্ষেও মত দেন তিনি।
বদলে গেল দৃশ্যপট: প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সুপারভাইজার নাসির উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলার পর পুরো চিত্রই পাল্টে যায়। দীন ইসলাম প্রতিবেদককে টেলিফোনে জানান, তিনি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে রওনা দিয়েছিলেন। পথিমধ্যে সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের চালক মোহাম্মদ আলী তাঁকে ফোন করেন। মাঝ রাস্তায় ওই বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স থেকে তাঁদের নামিয়ে ধানমন্ডিতে ডায়াগনস্টিকে নিয়ে যান। আবার ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসেন।
তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো অনলাইন পত্রিকা।